মহিউদ্দিন শামীম। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শামীম ছিলেন সবার বড়। বাবাকে হারিয়েছিলেন ছোট বেলায়। বাবার মৃত্যুর পর অনেক কষ্টে মা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে একটি চাকরি যোগাড় করেছিলেন। টেনেটুনেই চলছিল সংসার। মায়ের স্বপ্ন ছিল শামীম বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে।
মায়ের স্বপ্ন হাতছানি দিচ্ছিল। ছেলে টগবগে তরুণ। কলেজে পড়ছে। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করবে। দুঃখিনী মায়ের ঘরে আসবে শান্তি। কিন্তু ছেলে নাম লিখেয়েছে রাজনীতিতে। দায়িত্বও পেয়ে যান সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।
অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। শামীমের মায়ের ক্ষেত্রেও তা বাস্তব হোল! ১৯৮৮ সালে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে রাজপথে প্রাণ বিসর্জন দেন মহিউদ্দিন শামীম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে চট্টগ্রামে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে শামীম ছিলেন প্রথম।স্বপ্ন পূরণ হলো না বিধবা মায়ের। খুন হল একটি পরিবারের স্বপ্ন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, লালদিঘীর ময়দানে সমাবেশ ডেকেছিল আওয়ামী লীগ। আগে থেকে গুঞ্জন ছিল পুলিশ বাধা দিতে পারে সমাবেশে। সব বাধা উপেক্ষা করে শামীমরা ছুটে গিয়েছিল সীতাকুণ্ড থেকে। পথে পথে বিডিআরের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াকে উপেক্ষা করে এয়ারর্পোট থেকে নিউমার্কেট হয়ে কোর্ট বিল্ডিং যাচ্ছিল শেখ হাসিনার গাড়িবহর। শেখ হাসিনার গাড়িকে নিরাপদে কোতয়ালী মোড় পার করে দেওয়ার জন্য দারুল ফজল মার্কেটের সামনে মানব বেষ্টনী তৈরি করে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। সে বেষ্টনীতে উপস্থিত ছিল অভাগী মায়ের সন্তান মহিউদ্দিন শামীম।
কৃষ্ণ কুমারী স্কুলের দেয়াল থেকে বিডিআর গুলি চালায়। প্রথম দফা গুলির একটি নি:শব্দে উপরের চোয়াল দিয়ে ঢুকে মাথার পিছন দিয়ে কিছু মগজ নিয়ে বের হয়ে যায়। মাটিতে ঢলে পড়া শামীমকে ধরতে যান অমল দাশ। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটি তার চিবুক হয়ে বাম চোয়ালের একটি অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। অমল জ্ঞান হারালেও সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢরে পড়েন মহিউদ্দিন শামীম।
মহিউদ্দিন শামীমের মত সেদিন চট্টগ্রামে অসংখ্য তরুণ প্রাণ দিয়েছিলেন। যদিওবা পুলিশ চব্বিশ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী সেদিন সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী (পরবর্তীতে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বতর্মানে সীতাকুন্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক) জাহাঙ্গীর ভুঁইয়ার সঙ্গে। আবেগ প্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন শামীমের মা সন্তান হারানোর পর নেত্রী (শেখ হাসিনা) তাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় নেতারা উদ্যোগ নিয়ে পরিবারটির কোনো সাহায্য করতে পারেনি। পারেনি কোনো ধরনের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি দিতে।’
সময়ের কাজ গড়িয়ে যাওয়া। শামীমদের রক্ত দিয়ে দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়। কিন্তু বিস্মৃতির অন্তরালে যেন হারিয়ে যায় মহিউদ্দিন শামীম ও তার মত অনেকেই।
শামীমের মামা সাবেক ছাত্রনেতা শাহেন শাহ কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। সন্তান হারালে আমার বোন হারিয়েছে। এ যন্ত্রনা আর কেউ বুঝবে না।
২৪ জানুযারির সে দিন হত্যা করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। মহিউদ্দিন শামীম সেদিন তা রুখে দেয়। সেই হামলায় প্রথম শহীদ হয়ে নিজের নাম লিখে যান বিস্মৃতির খাতায়। নিজের জীবন দিয়ে সেদিন যারা ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন তাদের জন্য আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।