বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে গত একবছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন চেষ্টা চললেও তা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। উল্টো রাখাইনে অন্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে, বিপুল সংখ্যক এবং অপরাধজনক মানসিকতার রোহিঙ্গাদের কারণে নিজ দেশেই যেন পরবাসী হয়ে পড়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয়রা।

এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের।
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কক্সবাজারের বাসিন্দা মোমেনা বেগমের কথা। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গারা যখন নতুন করে বাংলাদেশে আসা শুরু করে, তখন নিজ বাড়ির উঠানেই একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ঠাঁই দিয়েছিলেন মোমেনা। পাশাপাশি বাড়ির বাইরে নিজের জায়গায় রোহিঙ্গাদের অন্তত ৭০টি ঘর তুলতে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু এখন তিনি নিজের জায়গা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে শঙ্কিত। বলেন, ‘‘ওরা বেশিদিন থাকবে না – এটা মনে করেই জায়গা দিয়েছিলাম। এখন তো ফেরত যাচ্ছে না।’’
এদেরকে আর রাখতে চান না বলে তিনি জানান, ‘‘এরা অর্ধেক ভালো তো অর্ধেক খারাপ। ওদের জনসংখ্যাও বেশি। কিছু বললে দা-বটি নিয়ে তেড়ে আসে।’’
আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা রিয়াদ মোহাম্মদ জানান, রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে তার চাষের জমি কমেছে। এছাড়া এখানকার গৃহিনীরা আগের মতো আর গরু-ছাগল পালন করতে পারছেন না। তিনি জানান, ‘‘আমাদের জমির যেগুলো এখনও বাকী আছে, সেখানে আগের মতো ফলন হয়না।’’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জমির পাশেই রোহিঙ্গাদের টয়লেট, গোসলখানা। ওদের মানুষ বেশি, চাষের জমিতেই ময়লা ফেলে।অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘‘আগে বছরে ১ লক্ষ টাকার আম বিক্রি করতাম। গতবার আম পাকার আগেই সবাই খেয়ে ফেললো।’’
এ তো গেল অহেতুক আগন্তুক রোহিঙ্গাদের হাতে স্থানীয়দের জমি বেদখল হওয়ার ঘটনা। রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যাহত হচ্ছে উখিয়ার জনগণের শিক্ষা ব্যবস্থাও। বালুখালি ক্যাম্পের উল্টোপাশেই গড়ে উঠেছে বালুখালি কাশেমিয়া উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটিতে রোহিঙ্গা নিবন্ধন ক্যাম্প থাকায় গত একবছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম একরকম বন্ধই ছিলো।
এখন সেটা চালু হলেও এলাকার যুবসমাজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্কুলটির একজন শিক্ষক বলেন, ‘‘গতবার এসএসসিতে আমাদের স্কুলের রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে। এবারো আমরা খুব একটা আশাবাদী না।’’
গত মাসের শেষ সপ্তাহেই শিশু অপহরণকারী সন্দেহে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে বেধড়ক পেটায় রোহিঙ্গারা। এছাড়া প্রায়ই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি-মারামারিতে লিপ্ত থাকে রোহিঙ্গারা। উখিয়া এবং টেকনাফে স্থানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি।
উদ্বিগ্ন প্রশাসনও
উখিয়া এবং টেকনাফে যেখানে স্থানীয় মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ, সেখানে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি ছাড়িয়েছে। ফলে বিভিন্ন ধরণের মানসিকতার এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে।
জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বিবিসিকে জানান, উখিয়া এবং টেকনাফের পরিস্থিতি নিয়ে তারাও উদ্বেগে আছেন।
তিনি বলছিলেন, এখানকার ডেমোগ্রাফিক সিচুয়েশন পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এভাবে দীর্ঘদিন সবকিছু চালিয়ে নেয়া কঠিন ব্যাপার হবে বলে তিনি মনে করেন। সবমিলিয়ে যে অবস্থা তাতে করে রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরানোকেই সমাধান মনে করছে বাংলাদেশে।
এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে কার্যকর সিদ্ধান্ত কামনা করেন।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে সরকারের মধ্যে কেন এই উদ্বেগ?
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে বলছিলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সেখানকার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে। সেখানে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
মনে করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন যে সংকট মোকাবেলা করছে তা অনেকটাই কমে যেতো যদি যথাসময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতো। কিন্তু একদিকে যেমন সেটা শুরুই হচ্ছে না, অন্যদিকে মিয়ানমার আদৌ তাদের ফেরত নিতে চায় কিনা, সেটা নিয়েও নতুন করে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
ফলে কক্সবাজারের এই বিশাল এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনের মধ্যে।