ডাকসু নির্বাচনে চমক দেখিয়েছেন নুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। সোমবার গভীর রাতে নির্বাচন কমিশন যখন ভোটের ফল ঘোষণা করে, তখন হাসপাতালে বেডে শয্যাশায়ী নুর।
২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে অন্য সব পদে ছাত্রলীগের প্যানেল নিরঙ্কুশ জয় পেলেও সর্বোচ্চ পদে চমক দেখিয়েছেন নুরুল হক নুর। চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করা এ নেতা জয়ী হয়েছেন বিপুল ভোটে।
ডাকসু নির্বাচনে নুরের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১১ হাজার ৬২টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ১৯৩৩ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন নুর। শিক্ষার্থীরা বলছেন ভিপি পদে নীরব ভোট বিপ্লব হয়েছে।
ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার বাড়ি পটুয়াখালীতে। এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা ও কারাবরণের মুখোমুখি হন।
সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন নুরুল হক নুর।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শুরু করেন আর দশজন ছেলের মত। ক্যাম্পাস জীবনের শুরুতে তার তেমন কোনো পরিচিতিই ছিল না।কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তিনি তাতে জড়ান। শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন। হাসান আল মামুন, রাশেদসহ অন্য সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এই পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক হন রাশেদ।
এই পরিষদে অন্তর্ভূক্তিই তার ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। এই পরিষদের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হলেও মূল কার্যক্রম নুরকে ঘিরেই পরিচালিত হয়েছে।
কোটা আন্দোলন চলাকালে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের অব্যাহত হামলার মুখে দমে যাননি নুর। কর্মসূচি দিয়েছেন, মাঠে থেকেছেন, একাধিকবার মারও খেয়েছেন। তবুও কোটা আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি।
নুর কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা ও কারাবরণের মুখোমুখি হন।শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জয় হয় নুরসহ কোটা আন্দোলনের নেতাদের।
শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, পরবর্তীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন নুর।শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে তুলে ধরেন দেশবাসীর কাছে। কোটা আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে যুক্ত করেন।
এই দুটি আন্দোলন নুরকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা যেখানে নিজ দলের লেজুড়বৃত্তি করে সেখানে নুর শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করেন।এটিই অন্যদের চেয়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন।
সবশেষ সোমবার ডাকসু নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনে রোকেয়া হল কেন্দ্রে ভোটের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়ে জ্ঞান হারান নুর। তারপরও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাকেই নেতা নির্বাচিত করেছেন।
হাসপাতালের বেডে শুয়েই ভিপি পদে জয়ের খবর পান নুর। ‘প্রহসনের ভোটে’ প্যানেলের সব প্রার্থীর পরাজয়ের মাঝে ভিপি পদে এ জয় যে তাকে খুব একটা খুশি করতে পারেনি সেটি বোঝা যায় তার কথায়।
সোমবার রাত ৩টার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় নুর বলেন, এ রকম নির্বাচন আমাদের কারোরই প্রত্যাশা ছিল না। প্রায় তিন যুগ পর এই নির্বাচন হলো। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল এই ভোটে। কিন্তু প্রত্যাশিত ভোট হয়নি। ডাকসু নির্বাচন কলংকের ইতিহাস সৃষ্টি করল।
নুর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল— আমরা ভেবেছিলাম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে আশার আলোর সঞ্চার করা হবে’-
কারচুপির অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যে কারচুপি করেছে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় পুরো দেশকে হতাশ করেছে। আমরা মনে করি, ১১ মার্চের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
ডাকসু নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, জালভোট, ব্যালটবাক্স ছিনতাই ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোটের দিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বর্জনের ঘোষণা দেয় নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন প্যানেল। বর্জন করা ভোটেই জয় পান নুর।
রাতে ফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে প্রায় দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে ডাকসুর সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন নুর। ভোট বর্জনকারী নুর শেষ পর্যন্ত ভিপি পদে শপথ নেবেন কিনা এই প্রশ্ন এখন শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে।
শিক্ষার্থীরা যাকে এত আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নেতা নির্বাচিত করলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব নেবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ তিনি আগেই ভোট বর্জন করেছেন। বর্জন করা ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি নুর ডাকসুর ভিপি হিসেবে শপথ নেবেন কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শপথ নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুল হক নুর বলেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাদে বাকি সব সংগঠন এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।